হলুদের ছাপঃ প্রিয় রঙ হলুদ - Berger Home Diaries
parallax background

হলুদের ছাপঃ প্রিয় রঙ হলুদ

By Tasnim Jarin

এমন কোন মানুষ আমই দেখিনি যার হলুদ রঙটা বেশ পছন্দ। এমনও হতে পারে হলুদ পছন্দকারী মানুষের সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আমার মতে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের রঙ নীল। কারো গাঢ় নীল পছন্দ, আবার কারো কাছে আকাশী নীল যুতসই মনে হয়।

আবার সাদাপ্রেমী মানুষের সংখ্যাটাও কিন্তু নেহায়েত কম না। কারো কারো কাছে আবার লাল বা গোলাপিটাও পছন্দের। কিন্তু হলুদ রঙ ভালো লাগে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কিছুটা দুষ্কর।

আসলে মানুষ হাতের কাছে যা পায়, তা তার কাছে অতটা প্রিয় হয়ে ওঠে না। নদীর ওপারের মানুষ সর্বদা এপারের মানুষগুলোকে হিংসা করে। এপারের মানুষগুলোর ক্ষেত্রেও তেমনি। দূরের জিনিসের প্রতি মোহ মানুষের মজ্জাগত। তাই নীল রঙের প্রতি মানুষের ফ্যাসিনেশন একটু বেশিই। উপরের নীলাকাশ দেখে তাই অনেকের মধ্যে কবিস্বত্বাও জেগে ওঠে। কিন্তু আকাশের ঐ রঙটা কি আদৌ ধরা সম্ভব? এই নীল রঙের ‘অধরা’ ব্যাপারটাই বোধ হয় তাকে সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

বেশিরভাগ মানুষই পছন্দের রঙ খুঁজে শপিং করার সময়। আমার ছোটবেলায় মার্কেট গেলেই সাদা রঙের জামাটাই মনে ধরতো। তাই ভাবতাম, সাদা বুঝি আমার মনের রঙ। আবার বোনদের দেখতাম লাল রঙের জামার প্রতি অতি মাত্রার আগ্রহ। অনেক ছেলেরা আবার নীল পাঞ্জাবী পরতে পছন্দ করে। হুমায়ুন আহমেদ আবার হিমু সাহেবের গায়ে তুলে দিয়েছিলেন হলুদ পাঞ্জাবী। হিমুর ভক্তের অভাব না থাকলেও হলুদ ভক্তের অভাব থেকেই গেলো।

দূরের জিনিসের প্রতি মোহ সেগুলোকে আমাদের পছন্দের তালিকার ওপরের দিকে তুলে দেয়। আর কাছের জিনিসগুলো কিন্তু অবহেলিত থেকে যায়। হলুদের প্রতি আমরা তাই সচরাচর মোহগ্রস্ত হই না।

তবে হলুদ কিন্তু একেবারেই আমাদের আপন রঙ। ব্যাপারটা আমই ছোটবেলায় বুঝতাম না। ভাবতাম সাদাই সব। সাদার মাঝেই সব রঙের সমাহার। তার মানে সাদাই সর্বেসর্বা।

তাহলে হলুদ রঙটা আপন কেন বললাম? শুধু আমার কাছে আপন না, সৃষ্টিকর্তার কাছেও আপন। সৃষ্টিকর্তা সূর্য থেকে যে সাতরঙা আলো পাঠান আমাদের কাছে তার মধ্যে হলুদ রঙটাই আমাদের চোখে ভালোমত ধরা পড়ে। মৌলিক রঙ হিসেবে আমরা জানি তিনটা রঙকে- লাল, নীল ও সবুজ। লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি আর নীলের সবচেয়ে কম। আর হলুদের মাঝামাঝি। তাই হলুদটা দেখতেই আমরা স্বাছন্দ্যবোধ করি। আগেই বলেছি, যা সহজে পাওয়া যায় তা আরাধ্য নয়। হলুদের কপালেও তাই যথার্থ আরাধনা জোটে নি।

হলুদ রঙের পাখি দেখে যে পুলকিত হয়ে ওঠে না তাকে ‘ব্যাপক আনরোমান্টিক’ স্বীকৃতি দেয়াই যায়। হলুদ রঙের মুনিয়া পাখিগুলো কত্ত আদুরে! হলুদ রঙা ‘সোনাবৌ’ পাখির নাম শুনেছেন? আর সাদা চোখ পাখি? হলদে পাখি নিয়ে তো আর এমনি এমনি গান হয় নি- ‘হলুদিয়া পাখি, সোনারই বরণ পাখিটি ছাড়িল কে’?

আর মেয়েরা, হ্যাঁ তোমাদেরই বলছি, তোমাদের হলুদ রঙ এত অপছন্দ আর পছন্দের ঐসব গয়নাগুলো! সোনার রঙ বিশ্লেষণ করলে কোন রঙ পাওয়া যায়, জানো? হলুদ!

হলুদের সবচেয়ে বেশি কদর দেখা যায় চায়নায়। কিং সাম্রাজ্য আর মিং সাম্রাজ্য চৈনিক সভ্যতায় হলুদের প্রতীক হয়েই আছে। হলুদ সম্রাট বলে হুয়াংদির গুণকীর্তন এখনো ওদের সংস্কৃতির অংশ।

ক্রিসান্থেমামের কথা জানেন? জাপানিরা এই হলুদ রঙের ফুলের শপথ নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল। আবার মেক্সিকোর অ্যাজটেকরা হলুদকে মনে করে খাদ্যের আরেক রূপ। শস্য দানার রঙের সাথে হলুদের মিলটাই তাদের মনে এই ধারনার জন্ম দিয়েছে।  

মনোবিজ্ঞানীরাও মনে করেন পৃথিবীর সব থেকে সুখী রঙ হলো হলুদ। হলুদ রঙের নান্দনিক পাথরের নাম বলে শেষ করা যাবে না। অ্যাম্বার, বেরিল, টোপাজ, জ্যাম্পার আর কত কি!

একটা মজার পরিসংখ্যান কি জানেন? প্রতিবছর আমেরিকাতে যে পরিমাণ পেন্সিল বিক্রি হয় তার ৭৫ শতাংশই হলুদ রঙের। মনে করে দেখুন তো, ট্যাক্সিক্যাব আর স্কুল বাস গুলোর রঙ কি?

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে শুরু করে ম্যাকডোনাল্ড সব ব্রান্ডের ছবিতে হলুদ দেখা যায়। হিন্দু ধর্মানুসারীগণ যে চক্রে বিশ্বাস করেন তাও কিন্তু ঐ হলুদই।

হলুদ যে গায়ে কিছু কালিমা মাখে নি, তা কিন্তু না। অনলাইন পোর্টাল গুলোতে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ দিয়ে অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশনের হিড়িক দেখা যায়। বাইবেলের মতে হলুদ রঙ আবার লালসার প্রতীক। প্রাচীন গ্রীসে হলুদ ছিল বিষাদের চিহ্ন আর ফ্রান্সে ছিল ঈর্ষার বহিঃপ্রকাশ।

হলুদের প্রতি আমার ভালো লাগা থেকেই হলুদের কেচ্ছা- কাহিনী নিয়ে এত ঘাটাঘাটি। মানুষের ভালো লাগা বা মন্দ লাগা আসলে কোনো নিয়ম মেনে চলে না, কোনো যুক্তি দিয়েও একে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। তবু যে জিনিসটা পছন্দের তার নাড়িনক্ষত্র জানতে কার না ভালো লাগে। যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলি, চোখে পড়ে যায় হলুদ জামা গায়ে দুরন্ত বালিকা। অথবা রাস্তার ধারে কিলোমিটার পোস্ট কিংবা দূরে কোনো সাইনবোর্ডে হলদে রঙে লেখাও আমাকে মুগ্ধ করে। বিয়ের কনের গায়ে হলুদ রঙ সোনার মত জ্বলজ্বল করে। কাঠগোলাপের সাদার মাঝে হলুদ রঙ আমাকে বিমোহিত করে। এভাবেই, কিভাবে যেন হলুদাসক্ত হয়ে পড়ি। আমার শুধুই মনে হয়, সবখানেই, সবকিছুতেই মেখে আছে হলুদের ছাপ।    

  •  
  •  
  •  
  •   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *