By Tasnim Jarin
ঘর সাজানো বিষয়টা বরাবরের মতো প্রতিটি মানুষের একান্ত পছন্দের এবং সৌখিনতার ব্যাপার। কেননা, সাজানো-গোছানো সেই ঘরটি মানুষের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। সেখানে ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তা-চেতনা একটা স্থান বা রূপ পায়। নতুবা যেমন-তেমন ডিজাইনের, রঙের কিংবা থিমের কথা না ভেবেই সাজানো হয়ে যেতো ভালোবাসার ছোট্ট সেই নীড়। কিন্তু আদতে তা করা হয় না। বরং, ঘরের প্রতিটি কোণায় একেকটা গল্প সাজিয়ে দেওয়াই হয় ঘর সাজানোর মূল উদ্দেশ্য। ব্যাপারটি যেন ঠিক এমন হয় যে, খাবার ঘরের মাঝ দেয়ালে রাখা কাঠের ঐ আয়নাটারও যেন একটা গল্প আছে, অস্তিত্বের ব্যাখা আছে।
ইট-কাঠের শহরে, বর্গকিলোমিটারের দালানগুলোতে আমাদের বসবাস। ছোট কিংবা বড়, বাড়ির আকৃতি যেমনই হোক না কেন, সাধারণত কোন একটা নির্দিষ্ট থিমের কথা ভেবেই আমরা অন্দর সাজানোর কাজ শুরু করে থাকি। এক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্ন এবং ক্ল্যাসিক একটা ভাব আনতে আপনি বেছে নিতে পারেন কাঠ এবং পৌরাণিক থিমের কম্বিনেশন।
যেমন ধরুন, লিভিং রুম কিংবা ড্রইং রুমের কথা। সাধারণ ফিক্সড গদি বা রড আয়রনের ফার্নিচারের থেকে সেগুন কাঠে ডিজাইন করা সোফার চাহিদা নিঃসন্দেহে অনেক বেশি। কিন্তু এর সাথে বাড়তি হিসেবে ড্রইং রুমের দেয়াল অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ছোট ছোট দেয়াল শেলফ বানিয়ে নিয়ে তাতে বই, ফটোফ্রেম কিংবা ছোট গাছের টব দিয়ে ডেকোরেশন করলে দেখতে দারুণ দেখাবে। সাথে ড্রইং রুমের ঠিক মাঝ বরাবর কার্পেটের উপর থাকবে কাঠের ডিজাইনে গ্লাস ফার্নিশড একটি টি টেবিল আর ঘরের কোণে একটি ল্যাম্প। আরও সুন্দর দেখাবে যদি প্রতিটি ঘরের লাইট বা ল্যাম্পের চারপাশে কাঠের কোন ফ্রেম বা বক্সের ডিজাইন করে দিলে।
কাঠের থিমের অবদান সময়কাল ভুলে সবসময়ই বিশেষ থাকে। আর এর সাথে কিছু পৌরাণিক শো-পিস যদি রাখা হয়, তবে দেখতে দারুণ দেখাবে। আপনি যদি কোন অ্যান্টিক শো-পিসের দোকানে যান তবে সেখানে পুরানো ডিজাইনের ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের দেয়াল ঘড়ি দেখতে পারবেন, যা কাঠের ফার্নিচারের থিমের সাথে বেশ ভালোভাবে মানিয়ে যায়। এমনকি মুখের অবয়বের মতো দেখতে অনেক শো-পিস যায়, যা ফুলদানি হিসেবে কিংবা ডেকোরেশন পিস হিসেবেও আপনি লিভিং রুম-সহ বাসার বিভিন্ন জায়গায় রাখতে পারবেন।
ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে আয়নার ভূমিকা যেন অনেক বেশি। আর তাই প্রতিটি রুমেই থাকা চাই কাঠের কারুকাজ করা ফ্রেমের আয়না। এক্ষেত্রে আয়নাগুলো বিভিন্ন আকৃতির হলে সুন্দর দেখাবে।
বিশেষ করে, ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপরের দিকে ফোকাস লাইটের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আর ঠিক পাশে থাকা শেলফে চুড়ি থেকে শুরু করে প্রসাধনী রাখার জন্য থাকবে ভিন্ন ভিন্ন সাইজের বক্স। এছাড়া কাঠের দরজার দেয়াল আলমারি বা ক্লোজেটে জুতো থেকে শুরু করে টাই প্রতিটি দরকারি জিনিসই রাখতে পারবেন টিপটপভাবে।
অন্যদিকে লিভিং রুমের জন্য কাঠের ইজি চেয়ার আর সাথে লিভিং রুম এবং বেড রুমের দেয়াল জুড়ে থাকবে কাঠের ফটোফ্রেম, দেয়াল ঘড়ি ম্যাগাজিন রাখার জন্য শেলফ। আপনি চাইলে ড্রইং রুমে ম্যাগাজিন রাখার জন্য কাঠ দিয়ে একটি ম্যাগাজিন হোল্ডার বানিয়ে নিতে পারেন, যার এক পাশে থাকবে কাউচ, ইচ্ছা হলেই যেন একটা ম্যগাজিন হাতে আপনি খানিকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারেন।
শুধু ঘরের আসবাবেই নয়, কাঠের থিমে সিলিং এবং ফ্লোরের ডিজাইনও যে ঘরের চেহারাই পাল্টে দিবে। আর এর জন্য যে খুব কষ্ট করতে হবে তা নয়। বরং, আপনি ফলস সিলিং-এর জন্য যে কাজটুকু করতেন, সে কাজটাই আরও সুন্দর ডিজাইনে করা সম্ভব কাঠ দিয়ে। সাধারণত মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা ন্যূনতম সাড়ে নয় থেকে দশ ফুট বা তার বেশি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পুরো বাড়ির পৌরাণিক ধাঁচের থিম যে সিলিং-এও থাকা চাই, নতুবা বাসা দেখতে সাদামাটা দেখাবে।
আর তাই, ছাদ থেকে দেড় ফুট নিচে ফলস ছাদের নিচের অংশে কাঠ কেটে পছন্দমতো ডিজাইনে সিলিং-এ বাক্স বা আড়াআড়ি আকারে কাঠের পাটাতন বসিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া কাঠের এই ধাপগুলোর ভেতর বসিয়ে দিতে পারেন ছোট-বড় কিছু স্পট লাইট। অথবা কাঠের চারিদিকে মরিচা বাতি দিয়েও ডেকোরেশন করতে পারেন। ঠিক একইভাবে ডাইনিং রুমের ছাদেও কাঠের একটা বাক্সের মতো ডিজাইন করে তার মাঝে সিলিং থেকে ঝুলানো লাইট বসিয়ে দিন, যেন ফোকাস ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে। একইভাবে বাচ্চাদের রুমেও সিলিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। লাইটের জায়গায় শুধু কাঁচের একটা গ্লাস বসবে কাঠের ফ্রেমের মাঝে। আর সেই গ্লাসের মধ্যে থাকবে সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ, চাঁদ, তারার স্টিকার, যা রাতের আঁধারে আলো দিবে, দেখতে দারুণ দেখাবে।
এছাড়া বাথরুমের উপরে থাকা স্টোরেজ ক্যাবিনেটগুলোও কিন্তু কাঠের করা যেতে পারে। আর এর সাথে মিলিয়ে কাঠের মেঝের ডিজাইন ঘরে নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটাবে। লিভিং রুমের কর্নারে কাঠের মেঝেতে হ্যান্ড পেইন্টের কয়েকটি কুশন রাখলে তা দেখতে দারুণ মানাবে। কাঠের মেঝের জন্য জার্মানির ওক কাঠ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সেগুন কিংবা মেহগনি গাছের কাঠ যেকোনোটাই বেছে নিতে পারেন, যদিও কাঠের মেঝে কিছুটা ব্যয় সাপেক্ষ হবে। মূলত ড্রয়িং, ডাইনিং এবং বেডরুমের জন্য কাঠের ফ্লোর বেছে নিতে পারেন। কার্পেটের মতো কাঠের মেঝেতেও ময়লা কম ধরে। তবে বাথরুমে কাঠের ফ্লোর না রাখাই ভালো। কেননা, পানিতে এ ধরনের মেঝে নষ্ট হয়ে যায়।
তাই টাইলস কিংবা মোজাইকের মেঝের চাইতেও কাঠের মেঝের যত্নটাও একটু বেশি করতে হয়। কাঠের ফ্লোর ঝকঝকে রাখার জন্য হোয়াইট ভিনেগার ও ভেজিটেবল অয়েল একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করলে তা কাঠের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে। তবে কখনোই সরাসরি কাঠের উপর এই মিশ্রণ ব্যবহার করা যাবে না। একটি স্পঞ্জ বা তোয়ালে এই মিশ্রণে ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে তা মেঝে পরিষ্কারে ব্যবহার করতে পারেন। এরপর একটি শুকনো কাপড় দিয়ে ভালোভাবে তা মুছে নিতে হবে, ব্যাস হয়ে গেল পরিষ্কার।
আর এভাবেই কিচেনের শেলফ থেকে শুরু করে ক্যাবিনেট, কিচেন হুডেও আনতে পারেন কাঠের ছোঁয়া। এছাড়া বারান্দা বা ঘরের খালি কোণে কাঠের টবে কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট রাখতে পারেন। ঘর সাজানোর জন্য এ ধরনের শো-পিস পেতে ঘুরে আসতে পারেন ঢাকার গুলশান-১ ডিসিসি মার্কেট, যা অভিজাত ও রুচিশীল ইন্টেরিয়র পিসের জন্য বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে কম খরচে রুচিশীল আসবাব কিনতে যেতে পারেন ঢাকার পান্থপথ, প্রগতি সরণি, মিরপুর স্টেডিয়াম, বাড্ডাসহ আরো বেশ কিছু এলাকায়।
এছাড়া জাহাজের পুরানো ফার্নিচার পাবেন পান্থপথ ও গুলশান-২ ডিসিসি মার্কেটে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের জাহাজের পুরানো ও অ্যান্টিক ধাঁচের ফার্নিচার পাওয়া যায়, যার কোন নির্দিষ্ট দাম নেই। এছাড়া কাঠের আসবাব কিনতে দেশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ফার্নিচারের শো-রুম, যেখান থেকে আপনি পছন্দসই ফার্নিচার কিনতে পারবেন।
কাঠ কিংবা পৌরাণিক থিম, যেভাবেই সাজানো হোক না কেন, হাতে একটু সময় নিয়ে শুরু থেকেই বাড়ির প্রতিটি কাজে প্ল্যান করে করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে একদিকে যেমন আপনি আপনার পছন্দমতো ঘরটি সাজাতে পারবেন, অন্যদিকে ঘর সাজানোর থিমটাও হবে অদ্বিতীয়। কেননা আপনার অন্দরমহলের ডিজাইনার যে আপনি নিজেই। আর সেখানে নিত্যনতুন মডার্ন সব ডিজাইনের পাশাপাশি পৌরাণিক চিত্রটাও যে আভিজাত্য রেশ ছড়াবে নিঃসন্দেহে। তো আপনার পছন্দ কোনটি, পৌরাণিক নাকি মডার্ন থিম?