by Tasnim Jarin
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর, আকাশের পশ্চিম কোণে যেই না এক চিলতে চাঁদের হাসির দেখা মেলে, ঈদের আনন্দটা যেন ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায়। আর হবেই বা না কেন? আগামীকাল যে ঈদ!
আর ঠিক তখনই ঘরে যেন একটা হুলস্থুল শুরু হয়ে যায়। ঘর সাজানো-গোছানো, ঈদের খাবারের মেন্যু প্রস্তুত করা, হাতে মেহেদি লাগানো, ঈদের পোশাকটা ঠিকঠাক করে নেওয়া, আর অন্যদিকে সমানতালে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় তো চলছেই। সাথে পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঈদের ঘোরাঘুরি এবং সালামি আদান-প্রদান এর পরিকল্পনাও চলতে থাকে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এবারের ঈদটা আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে পার করতে যাচ্ছি। একদিকে লকডাউনের জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার উপর রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ, অন্যদিকে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক তো থাকছেই। কিন্তু এসবের মধ্যে বিশেষ এই দিনটির উদযাপন কি থেমে যাবে?
না, থেমে যাবে না। বরং, এই ঈদ আয়োজনটা হবে আরও বিশেষ কেননা এবারের ঈদ উদযাপনের পুরো সময়টা আমরা আমাদের পরিবারের সাথে কাটাতে পারবো। ঈদের নামাজ পড়ার মধ্য দিয়ে দিনটা শুরু করে একসাথে খাবার খাওয়া, সালামি নেয়া, টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখা, ভিডিও কলে বন্ধুদের সাথে কথা বলা – এসবই চলবে ঘরে বসে। ঘরে থেকেই এবারের ঈদ আমরা উদযাপন করবো একেবারে ভিন্নরূপে। আর তারই অংশ হিসেবে আমরা ঈদ উদযাপন কিভাবে করবো, সেটার কিছু প্ল্যান করে ফেলতে পারি আগে থেকেই।
এবারের ঈদে কোন ঘুরাঘুরি নেই, দাওয়াত নেই, বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ নেই; এসব ভেবে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকলে যে একেবারেই চলবে না! এবারের ঈদ আয়োজন হবে বাসাতে একেবারে নিজের মতো করে। আর এই ঈদের আমেজ ধরে রাখতে আমরা পুরো ঘর সাজানোর পাশাপাশি ঘরের একটি বিশেষ জায়গাকে ‘ঈদ সেলিব্রেশন কর্নার’ হিসেবে সাজাতে পারি।
এক্ষেত্রে পছন্দমতো রঙের চার্ট পেপার কিংবা রঙিন কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করে দেয়াল সাজিয়ে নিতে পারি। চাঁদ, তারা, ফুল বা মিনারের ডিজাইনে কাগজ কেটে নিয়ে এর মধ্যে সোনালি বা রূপালি রঙের গ্লিটার ছিটিয়ে দিয়ে রিবন বা মোটা সুতায় আঠা দিয়ে কাগজগুলো বসিয়ে নিয়ে ঘরের নির্দিষ্ট কর্নারে ঝুলিয়ে দিন বা দেয়ালে এঁটে দিন।
কর্নারের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতে দেয়ালে মরিচ বাতি দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারেন। এছাড়াও ফ্লোরে কার্পেটের উপর কুশন বা পিলো রেখে বসার ব্যবস্থা করতে পারেন। বাসার কেউ যদি গান করতে পারেন, তবে একটা গানের আসরও করা যাবে এখানে অথবা পরিবারের সবাই মিলে জম্পেশ আড্ডাও দিতে পারবেন। আত্মীয়স্বজনদের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গ্রুপ ভিডিও কলও করতে পারেন স্পেশাল এই কর্নার থেকে। যেহেতু বাসার বাইরে যেতে পারছেন না, তাই ঘরেই ঈদের আমেজ আনতে ‘ঈদ সেলিব্রেশন কর্নার’ হতে পারে একটি পারফেক্ট জায়গা!
ঈদের উৎসব মানেই যেন হরেক রকম মজাদার খাবারের আয়োজন। ঈদের দিনের শুরুতেই তাই থাকা চাই মিষ্টি জাতীয় খাবার। আর সে তালিকায় জর্দা, মিষ্টি, সেমাই, গাজরের হালুয়া, কুনাফা, পুডিং ইত্যাদি কয়েক রকমের মিষ্টি জাতীয় খাবারের পাশাপাশি ঝাল আইটেম হিসেবে পাস্তা, চটপটি-ফুচকা, কাবাব ইত্যাদি রাখতে পারেন।
আর দুপুর এবং রাতের খাবারের বিশেষ আয়োজনে রাখতে পারেন পোলাও, কোর্মা, রোস্ট, তেহারির মতো মজাদার সব আইটেম। এছাড়াও কালা ভুনা, বিফ মাসালা, সাসলিক, খিচুড়ি, বিরিয়ানি আর বোরহানির মতো স্পেশাল সব খাবারও থাকতে পারে তালিকায়।
তবে যেহেতু খুব গরম পড়েছে, তাই খাবারে যথাসম্ভব তেল-মসলা কম দিয়ে রান্না করলে তা স্বাস্থের জন্য উপকারী হবে। আর এসব খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের শরবতের ব্যবস্থাও করতে পারেন। এছাড়া আপনারা আপনাদের পছন্দমতো খাবারও এই তালিকায় যুক্ত করতে পারেন। তবে খাবারের অপচয় যেন কোনভাবেই না হয়, সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
বিশেষ করে আমাদের বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থায়, পারলে আশাপাশের দরিদ্র মানুষগুলোকে এই ঈদের দিনে বাসার রান্না করা খাবার দিতে পারলে ঈদের আনন্দ যে হবে দ্বিগুণ, ভাগাভাগি করে নেওয়া যাবে ঈদের আনন্দ সবার সাথে।
ঈদের এই বিশেষ দিনে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে কোলাকুলি করতে পারছেন না, সবাই মিলে জামাতে নামাজ পড়তে পারছেন না, একজন আরেকজনের বাসায় গিয়ে জর্দা-সেমাই খেতে পারছেন না, এতে মন খারাপ লাগবে এটা খুবই স্বাভাবিক। বছরের এই দিনটির জন্য আমাদের অপেক্ষাও যে থাকে অনেক। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত এইসব পরিস্থিতে সুস্থ থাকাটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আর তাই তো এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
তবে এই দূরত্ব কাটিয়ে তুলতে ভার্চুয়াল দুনিয়াই যে এখন আমাদের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ। এবার এই ভিন্ন রকমের ঈদে তাই কোলাকুলিটাও হোক একটু ভিন্ন স্টাইলে। নামজ শেষে ভিডিও কলে এসে আমরা একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করতে পারি আর ডিজিটালি সালামিটাও নিয়ে নিতে পারি। অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং তৎক্ষণাৎ ব্যালেন্স ট্রান্সফারের এই যুগে যেন কোনকিছুই আর থেমে থাকবে না।
তাই বড়রা ছোটদের মন রক্ষার্থে আর ভালোবাসা স্বরূপ ঈদের সালামিটা এবার কোলাকুলি শেষে তৎক্ষণাৎ ডিজিটালি দিয়ে দিন আর হয়ে উঠুন ছোটদের কাছে মোস্ট ফেভারেট! আর এই ভিডিও কলে ঈদের কোলাকুলি এবং ঈদ সেলফি তোলার কাজটা পুরোপুরি করতে পারি ঘরের ‘ঈদ সেলিব্রেশন কর্নার’ থেকে। ঘরেই ঈদ আমেজের এই দারুণ আয়োজনে ঈদ হয়ে উঠবে আরও রঙিন এবং আনন্দময়।
শুধুমাত্র ঈদ কেন, যেকোনো উৎসবের আয়োজনই বৃথা হয়ে যায় যদি আপনার-আমার পাশের অসহায় মানুষটি অনাহারে থাকে, আর আমরা ঈদ আয়োজনে ব্যস্ত থাকি। ঈদ মানেই হলো সবার সাথে আনন্দ-খুশি ভাগাভাগি করে নেয়া। বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এই দিনটিকে আরো রঙিন করে তুলতে তাই অসহায় মানুষের সাহায্যার্থে আমাদের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের ছোট একটি উদ্যোগই হতে পারে বিশেষ এই দিনে তাদের মুখে হাসি ফোটানোর একটি বড় কারণ।
আর এক্ষেত্রে অন্যবার থেকে এবারের আয়োজনটা হতে পারে ভিন্ন, যেখানে পরিবারের ছোটরাও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ডিজিটাল সালামির এই সময়ে প্রাপ্ত সালামির পুরো অর্থটাই আমরা অসহায় মানুষদের সাহায্যে দিয়ে দিতে পারি। এতে করে পরিবারের ছোট-বড় সবাই মিলেই কোন বৃহৎ কাজের অংশ হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারি।
অন্যান্যবারের মতো এবারের ঈদে হয়তো আমরা বাসার বাইরে যেতে পারবো না, বন্ধুদের সাথে সামনাসামনি আড্ডা দিতে পারবো না কিংবা ঈদের বিকেলের সেই ঘোরাঘুরিটাও হচ্ছে না। কিন্তু তাতে কি ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে যাবে? পরিবারের সবার সুস্থতায়, পরিবারের সবার সাথেই না হয় এবারের ঈদটা রঙিন হোক ঘরে থেকে। যেন পরের ঈদ আমরা সবাই একসাথে আনন্দ কাটাতে পারি কোনরকমের দুশ্চিন্তা ছাড়াই।
সবাইকে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। পরিবারের সবার সাথে এবারে ঈদ উদযাপন হোক একটু ভিন্নরূপে। ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেই আমাদের পাশের অসহায় মানুষটির প্রতি, আর এভাবেই রঙিন হোক আমাদের ঈদ আয়োজন।
ঈদ মুবারক!